৮ মে-২০২০।বাংলাদেশে করোনা প্রাদূর্ভাবের দুই মাস ফূর্তি হল।৮ই মার্চ -২০২০ তারিখে মাত্র একজন রোগীর মাধ্যমে বাংলাদেশ আক্রান্ত দুনিয়ায় তার নাম লিখাই। তার ঠিক একমাস পরে অর্থ্যাৎ ৮ এপ্রিল-২০২০ দেশে মোট রোগী ছিলেন ২১৮ জন। ওই সময় পর্যন্ত সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছিল ২২ জেলায়। সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের দুই মাসের মাথায় এসে দেশে মোট রোগী শনাক্ত হন ১৩ হাজার ১৩৪ জন। দ্বিতীয় মাসে আক্রান্ত বেড়েছে ১২ হাজার ৯১৬ জন, যা মোট শনাক্তের ৯৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত এক মাসে নতুন ৪২টি জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে।বর্তমানে দেশের সবকটি জেলায় সংক্রমিত।দেশে আজ (০৮ এপ্রিল) পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে মোট ২০৬ জন মারা গেছেন। এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন ২ হাজার একশ একজন। আজ পর্যন্ত সুস্থতার হার ১৬ শতাংশ।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে দুই মাস শেষে মোট আক্রান্ত ছিলেন ১৫ হাজার ২১৯ জন। মোট আক্রান্তের ৯৯ দশমিক ৯০ ভাগই আক্রান্ত হয় দ্বিতীয় মাসে। ইতালিতে সংক্রমণের দুই মাসে মোট আক্রান্ত ছিলেন ৯২ হাজার ৪৭২ জন। এর ৯৮ দশমিক ৭৮ শতাংশই দ্বিতীয় মাসে আক্রান্ত হয়। স্পেনে দ্বিতীয় মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ওই সময় পর্যন্ত মোট আক্রান্তের ৯৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে প্রথম দুই মাসে মোট আক্রান্ত ছিলেন ২৫ হাজার ১৫৪ জন। এর ৯৯ দশমিক ৮৫ শতাংশই আক্রান্ত হয় দ্বিতীয় মাসে।যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তৃতীয় মাসে। প্রথম দুই মাসের তুলনায় তৃতীয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৯৭ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৮৫ শতাংশ রোগী বেড়েছিল। স্পেনে এটি ছিল ৫৫ ও ইতালিতে ৫৪ শতাংশ।সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রক্ষেপন অনুযায়ী আগামী ৩০ মে-২০২০ নাগাদ এদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হতে পারে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার।যদি তাই হয় তাহলে দেশের প্রতিটা জেলায় রোগীর গড় সংখ্যা হতে পারে সাতশত পঞ্চাশ থেকে সাতশত আশিজন।প্রতিটি উপজেলায় রোগীর গড়সংখ্যা হতে পারে ১০০ জন।এই ১০০ জন হতে পারে আলাদা একশটি পরিবারের সদস্য অথবা পরিবারের সংখ্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেশি অর্থ্যাৎ একই পরিবারে একাধিক আক্রান্ত হতে পারে।যে বাড়িতে একটা করোনাভাইরাস পজিটিভ কেস পাওয়া যাবে ঐ বাড়িসহ আরো দশটি করে বাড়ি যদি লকডাউন করা হয় তাহলে সকল উপজেলায় গড়ে একহাজার বাড়ি লকডাউন করা লাগতে পারে।এভাবে ৪৯২ উপজেলায় চারশত বিরানব্বই হাজার বাড়ি অর্থ্যাৎ চার লাখ বিরানব্বই হাজার বাড়ি সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে।যদি প্রতিটা বাড়িতে গড়ে পাঁচজন করে লোক সংখ্যা হিসাব করি তাহলে অচলাবস্থা সরাসরি শিকার হবেন চব্বিশ লক্ষ ষাট হাজার লোক।এখন কথা হলো যদি কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের এই পর্যায়ে এটি দমন করা না যায় তাহলে ব্যাপারটা কতটা ভয়াবহ হবে তা সহজে অনুমেয়।প্রতিটা উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন আক্রান্ত হলে কে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে?কেই বা লকডাউন দিয়ে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বিনীত আহ্বান জানাবেন।তখন হয়ত পুলিশ,আর্মি,নির্বাচিত প্রতিনিধি কিংবা উপজেলা প্রশাসকগণও অনেকে আক্রান্ত থাকবেন।এই ভয়াবহ অবস্থায় পতিত হবার আগেই আমাদের স্বস্ব অবস্থান থেকে নিজদের প্রস্তুতি নিতে হবে।প্রতিটা বাড়ি/বাসাকে একেকটা কোয়ারান্টাইন সেন্টার হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।ফরমান জারি করতে হবে যাতে বাড়ির কর্তা কিংবা কর্ত্রীর হুকুম ছাড়া কেউ ঐ ঘরে প্রবেশ কিংবা বাহির হতে না পারেন।জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলেও তাকে অবহিত করে তার অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।বাহির থেকে এসে তার সম্মুখে ভালোভাবে হাতমুখ সাবান পানিদিয়ে ধূয়ে তারপর সেগৃহে প্রবেশাধিকার পাবে।প্রতিটা বাড়ির কর্তা সংশ্লিষ্ট বাড়ির সকল সদস্যদের ভালোমন্দ দেখবাল করবেন।বাড়ির কর্তা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহন করবেন।প্রয়োজনে ঐ বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হলে বাড়ির কোন রুমে তাকে আলাদা করে সেবা প্রদান করা হবে তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখবেন।আর যদি বাড়িতে ঐ রকম কোন রুম বা ঘর না থাকে তাহলে কোন আইসোলেশন সেন্টার বাড়ির নিকটে তাও আগে থেকে ঠিক করে রাখবে।বাড়িতে ঘর ঠিক করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আলোবাতাস চলাচলের ব্যবস্থাসহ আলাদা টয়লেট সুবিধা সম্বলিত রুমটি বরাদ্দ করাই শ্রেয় হবে।আসন্ন ঈদে অতিথি নিয়ন্ত্রণ করাটাও উনার দায়িত্বে থাকবে।সন্দেহজনক কোন অতিথি আপাতত এই ঈদে গৃহে প্রবেশের অনুমতি পাবেননা।সংশ্লিষ্ট গ্রাম/ওয়ার্ডের বাহির থেকে যেন কোন অতিথি ঘোষিত সময়ে কারো আতিথ্য গ্রহন করতে না পারেন তা আগেই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের জানিয়ে রাখবেন।পরিবারের সদস্যরা প্রতিদিন কয় যাচ্ছেন কাদেরবসাথে মিশছেন তার হিসাবও বাড়িকর্তার খাতায় থাকবে। সরকার সকলের কথা বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত সীমিত পরিসরে আগামী ১০ মে-২০২০ থেকে কিছু কিছু প্রতিষ্টান নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছেন।২৫ মার্চ-২০২০ তারিখ থেকে চলা একটা সাধারণ ছুটিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িদের অবর্ননীয় দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস এটি।সরকার তার প্রজ্ঞাপনে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন কোন প্রতিষ্টান খোলা রাখা যাবে,কতক্ষণ খোলা রাখা যাবে,কোন কোন স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে ইত্যাদি।আমাদের অনেকে পুরো প্রজ্ঞাপনটি ভালোভাবে নাপড়ে ঢালাও ভাবে সরকারের সমালোচনা লিপ্ত হচ্ছেন।তারা কেউ একবারও ভাবছেন না সরকার কেবল একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠীর কথা ভাবেননা তাকে সকলের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।সরকারের সমালোচনাকারীদের বড় অংশের আশংকা দোকানপাট খোলার অনুমতি পেয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্রেতা-ক্রেতা এক এলাকা থেকে অন্য এলাজায় গিয়ে করোনাভাইরাস বিস্তার ঘটাবেন।তা মোটেও অমূলক নয়;কিন্ত সরকার প্রজ্ঞাপনে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন বিভিন্ন জেলা,উপজেলার অভ্যন্তরিণ দোকানপাট সীমিত আকারে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে তবে এক্ষেত্রে আন্তঃজেলা/উপজেলা যাতায়াত/চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।তার মানে হল আমি চাইলেই একজেলা কিংবা উপজেলা থেকে অন্য জেলা কিংবা উপজেলায় কেনাকাটা করতে যেতে পারবোনা।যদি যায় তাহলে আমি নিজেই সরকারি আদেশ আমান্য করব,আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আমাকে আইনের আওতায় আনবে।ভয় হল আমরা কতটা সরকারি নির্দেশনা মানি বা মানব?একটি দেশের অধিকাংশ নাগরিক আইন ভঙ্গ করলে সেদেশে আইনের কার্যকারিতা থাকেনা।আবার একটি দেশের সবাই আইন মেনে চললে সে দেশে আইনের প্রয়োজন পড়েনা।দেশের একজন নাগরিক হিসাবে সিদ্ধান্ত আমাদের আমরা কোন পথে যাবো।দোকানপাট খুলে দিলেই কি আমাকে দোকানে গিয়ে অযথা ভিড় জমাতে হবে!দোকান ত দোকানই এটা কিন্তু মেজবাননা।বিনা প্রয়োজনে কেউকে ঘরের বাহিরে নাযাবার তাগিদ সরকারের তরফ থেকে শুরু থেকেই ছিল থাকবে।প্রতিদিন আইইডিসিআরের সরকারি স্বাস্থ্য বুলেটিনে নিয়মিত আপডেট এর পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য টিপস দেওয়া হয়,আমাদের প্রত্যেকের উচিত ঐসব টিপস মেনে চলা।আবার এও ইদানীং দেখা যাচ্ছে টানা দুই মাস যাবৎ মাস্ক ব্যবহার করা লোকরাও কেউ কেউ মাস্ক ছাড়া বাহিরে গমন করছেন।তাদের অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা যেন সাবানপানি দিয়ে হাত ধূতে ধূতে আর মাস্ক ব্যবহার করতে করতে একধরনের ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন!দোকানপাট যতোই খোলা হোক এখনো কিন্ত করোনাঝুঁকি এতটুকুও কমেনি।জীবন যার সিদ্ধান্ত তারই হওয়া যৌক্তিক। আমরা কেবল পরামর্শ দিচ্ছি।মানা নামানা পুরোটাই আপনার।আপনি বাচঁলেই আপনার পরিবার ভালো থাকবে।পরিশেষে বলতে চাই সামাজিক দূরত্ব না মানলে করোনাভাইরাস আমাদের সাথে কোলাকুলি করতে আসবে।সুযোগ বুঝে হয়ত ধরাশায়ী করে যাবে।আসুন কেবল সরকারের ঢালাওভাবে সমালোচনা না করে আমরা ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হই;করোনা প্রতিরোধে পারিবারিকভাবে উদ্যোগ গ্রহন করি।
লেখক,
জিয়াউর রহমান মুকুল,
উপ-পরিচালক,
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, শেড।
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মতামত